তোমার প্রেমিক তিলেক দাঁড়াক জানলায়
প্রিয় বন্ধু, প্রিয় আনন্দ কয়েকটি তাজা শ্বাস নেওয়ার জন্য
তোমার কাছে এসেছি,
দেয়ালে টাঙানো হিরণ মিত্র, তলায় ছাব্বিশ দিন টানা আড্ডা।
ঘরের ভেতর সমুদ্রের নোনা জল ঢুকে পড়ত,
ঢুকে পড়ত বাদল পোকার দল।
আমরা বুঝেছিলাম এই নোনা জলের মাঝে
শুধু শ্রবণেন্দ্রিয় থাকাই যথেষ্ট নয়,
সেই প্রাচীন গমগমে আওয়াজ বুঝতে গেলে বসুন্ধরার
দশম দিক খুলে নিয়ে আসতে হবে
কঠিন শিক্ষাপর্ব, শাল্মলী বৃক্ষছায়া।
ভেসে যেতে যেতে পৃথিবীকে ধরতে হবে বিদ্যুৎবর্ণ খড়কুটো।
প্রিয় বন্ধু প্রিয় আনন্দ সাদা ফুল লাল ফুলের পাশে তুমি বলতে
দিদার গল্প,
কু-বাতাস তাড়ানোর মন্ত্র, গম ঝাড়ার আওয়াজ।
আমরা ছুঁয়ে ফেলতাম তোমার সীমানা ছাড়ানো গানের কিনার,
ব্রজমানিক গাঁথা সেসব গীত গাওয়ার জন্য
তুমি আড়াল নিতে অর্জুন গাছের ডাল।
আমাদের জানলারা একদিন দূরে সরে গেল,
হাতগুলো খসে পড়ল পরস্পরের হাত থেকে,
কটূ গন্ধ ঘিরে ধরল আমাদের লিভিংরুম,
দুটি ফ্ল্যাটের মধ্যে গভীর খাদ।
খাদের ভেতর শ্বাপদের দল ঢুকে পড়ল।
ঢুকে পড়ল রাগী রোদ, শাস্তির চিহ্নরা।
আমাদের দুটি বাংলোর মধ্যে গজিয়ে উঠল পাহাড়।
বুড়ো প্রজাপতি যথা নিঃশব্দে সরে গেল কাঁকর বিছানো রাস্তারা,
মাথার ওপর পেঁচাদের নিভৃত ডাক।
প্রিয় বন্ধু প্রিয় আনন্দ কয়েকটি তাজা শ্বাস নেওয়ার জন্য
তোমার কাছে এসেছি, দেয়ালে হিরণ মিত্র।
তোমার পিঠ বেঁকে গেছে, ঘাড়ের হাড়ে চিড়।
তবু তুমি ধরে রেখেছ নোনা জলের স্মৃতি, তরঙ্গ
সুগন্ধিত সেইসব ভোজসভা।
বন্ধু প্রতিটি ভোজ সভায় থাকত তোমার দাদার স্মৃতিলেখ,
শাল গাছের পাতা বোনা মেয়েরা, পবিত্র কাকুর ডাঙালা ঝুমুর,
প্রিয় বন্ধু প্রিয় আনন্দ আজও তুমি ভাবো
আমাদের হাতগুলি জুড়ে যাবে ফের,
মানুষে-মানুষে সম্পর্কের ভেতর ঠা ঠা প্রান্তর,
কাঁটা ঝোপ, কুমিরের গায়ের চামড়ার মতো
ধু ধু বালি, পার হওয়া সম্ভব।
প্রিয় বন্ধু আমি এসেছি দুই বাংলোর মাঝখানের পাহাড় ডিঙিয়ে
পাহাড়ের কাঁধের একপাশে বর্ষা ঋতুর গর্জন
পথ পিচ্ছিল, ঘাতক পাখি ওত পেতে বসে পাথরের খোদলে,
কালো রঙের দৈত্য আমাকে আটকে রেখেছিল লিভিংরুমে একা।
একা দিন এসে দাঁড়াত দরজায়,
বন্ধু চিহ্নহীন, আড্ডা চিহ্নহীন, বুড়ি চাঁদ চিহ্নহীন।
একাকীত্বের বুনো জন্তু ঘুমোয় না, জেগে থাকে সারা রাত।
খবরের কাগজ থেকে খসে পড়ে পোড়া শরীর, কাটা হাত,
লোভী, দুরাচারী রাজমন্ত্রীর হুঙ্কার।
মৃত সৈনিকের কফিন ঘিরে কান্না।
বন্ধু তুমি কোন সাহসে এখনও কিনে ফেল রবীন্দ্র চিত্রের বিপুল সংগ্রহ,
আমার শ্বাস গ্রহণের জন্য মেলে ধরো
সত্তর বছর পার করা কবির দুঃসাহসিক কারুকাজ।
এই মুখাকৃতিতেই কি কবি পুরে দিয়েছেন
পৃথিবীর অসুখ, কৃতি আর আকৃতির
কান ঘেঁষে নেমে যাওয়া গভীর খাদ?
চুপ মেরে যাওয়া নৌকার মতো দুলতে থাকে আমার লিভিংরুম,
প্রিয় বন্ধু এই মুখাকৃতিতেই কি কবি পুরে দিয়েছেন
কৃষ্ণ বাতাস, মানুষের অন্তহীন চলা, যারা হাসে আর কাঁদে,
যারা মাটি আর নদীর গান গায়।
সেই সব বিহঙ্গ মানুষ, শব্দ আর জল দিয়ে তৈরি মানুষ।
আমার বাংলোর চারিদিকে দুর্ভেদ্য পাহাড়।
একাকীত্বের পশু লালা ফেলে ফেলে ঘুরে বেড়ায় নির্জন ঘরে,
বাইরে ঘাতক পাখি, বাইরে হত্যার চক্রান্ত,
বাইরে ধাতব স্রোত, বাইরে কৃত্রিম উল্লাস,
বাইরে ক্লিপটো কারেন্সির মায়াবী হাত, জটিল ঘূর্ণি,
প্রিয় বন্ধু, প্রিয় আনন্দ তুমি এখনও সাজিয়ে রাখো
গাছ আর কুশন— আমরা বসব তাই।
দেয়ালে হিরণ মিত্র— বেনারসের ঘাট, সিঁড়ি
ওপরে রঙিন ছাতা। স্রোত বয়ে যায়।
বয়ে যাওয়া আঁকা স্রোতের পাশে, তুমি বলছ নতুন প্রেমিকার কথা,
যে তোমার ডানা পুড়িয়ে দেয় মোমের শিখায়,
তোমার অন্য প্রেমিকা, যাকে তুমি নাম দিয়েছিলে আগুন পতঙ্গ,
জাদুবলে তোমাকে নেকড়ে বানায়, আর শিকারী কুকুর লেলিয়ে দেয়,
বন্ধু কাটা চিবুকের মেয়েটির পাশে
তুমি ছিলে সাদা ঘোড়ার রূপধারী, ছদ্মবেশী রাজপুত্র, নিঃশ্বাসে সুগন্ধ,
মেয়েটি তোমার কেশর কেড়ে নেয়।
তুমি বনে-বাদাড়ে দাঁড়িয়ে কেঁদে ওঠো—
আমার কেশর, আমার কেশর,
তোমাকে দেওয়া হয় চাবুক আর অঙ্কুশের খোঁচা।
তবু তুমি ছিলে তার অনুগামী বাহক।
তার কন্যাকে নিয়ে আসতে সাঁতারের ক্লাস থেকে।
আয়োজন করতে মহাভোজ সভার,
মাসের পর মাস আমি বিশ্বাস করতাম
খোলা জানলাওলা তোমার ফ্ল্যাটটাকে, হিরণ মিত্রের ওই ছবিকে।
প্রিয় বন্ধু তুমি এখনও স্বপ্ন দেখো ?
সাদা ঘোড়ার লাফ, নোনা জলের গর্জন, লাল ফুল, সাদা ফুলের বাগান।
এখনও ভাবো ষোলো সিটের উইংগার বুক করে
আমরা বেরিয়ে পড়ব বুড়ি চাঁদের দিকে,
আসাননগর, চুয়াডাঙা, মানিকেশ্বরের দিকে।
বন্ধু দুনিয়া জুড়ে ক্লিপটো কারেন্সির রণভেরী।
দেবতাহীন শহরেরা দাঁড়িয়ে পর পর,
কয়লা আর চুনাপাথরের খনির ঘস ঘস আওয়াজ,
ত্রস্ত পায়ে হাজির হয় আমার আত্মা।
ঝোড়ো হাওয়া আর রাতের সঙ্গী সে।
কানের কাছে ধাক্কা দেয় স্মৃতিহীন তুলা বীজের মতো হারানো
মানুষের শেষ ডাক।
বন্ধু তুমি এখনও বলে চলেছ, একটা জীবন শিল্পের জন্য দণ্ডিত থাক।
বলছ শ্বাস গ্রহণ করো কবির চিত্রকলায়, শক্তি সঞ্চয় করো।
আমার হাতে তুলে দিয়েছ তেরোটি হাওয়ার সাগর,
তুলে দিয়েছ জাহিরুল হোসেন, পুতুল নাচ, মানিকেশ্বর মন্দিরের সিঁড়ি।
প্রিয় বন্ধু আমাদের জানলারা সেজেছে নতুন পর্দায়।
কথা হোক, জানলাদের কথা হোক।
তোমার অবুঝ প্রেমিকা তিলেক দাঁড়াক জানলায়।
তুমি তাকে প্রতীক্ষা দিও, তাকে দিও সোনার চাকাওলা গাড়ি আর মেঘ।
যার চুলে লেবু পাতার সুবাস, কফি বীজের সুঘ্রাণ।
বৃষ্টি নামুক।
তোমার কুশনে ঠেস দিয়ে আমি দেখতে থাকি কবির চিত্রবই।
মুখাকৃতিতে লুকোনো মানুষের স্রোত। টিঁকে থাকার অদম্য জেদ।
জানলাদের কথা হোক, লেবু পাতার গন্ধওলা চুলের ওপর বৃষ্টি নামুক।